বিশ্বের সেরা পাঁচটি গাড়ি নির্মাতা কোম্পানি

বর্তমান সময়ে প্রাইভেট গাড়ির চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যাতায়াতের জন্য সকলেই চাই যে নিজের একটি প্রাইভেট গাড়ি থাকুক। ২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীতে মোট গাড়ির সংখ্যা ১.৪ বিলিয়নের বেশি। উন্নত দেশগুলোর বেশিরভাগ মানুষই প্রাইভেট গাড়ি ব্যবহার করে থাকে এবং বর্তমানে উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও প্রাইভেট গাড়ি চাহিদা প্রতিনিয়ত ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই বিপুল চাহিদা বৃদ্ধির ফলে গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিনিয়ত অত্যাধুনিক প্রযুক্তির এবং বিভিন্ন মডেলের গাড়ি মার্কেটে আনছে। বর্তমানে পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তন সহ বিভিন্ন সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বহু দেশের সরকার ইলেকট্রিক গাড়ি ব্যবহারের কথা বলছে এবং ইলেকট্রিক গাড়ির উপর বিভিন্ন ধরনের করমুক্তি দেওয়া হচ্ছে। সরকারি প্রচার ও বিভিন্ন ধরনের সুবিধার কারণে ইলেকট্রিক গাড়ির চাহিদা প্রতিনিয়ত ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আজকের এই পোস্টে বিশ্বের সেরা পাঁচটি গাড়ি নির্মাতা কোম্পানি নিয়ে আলোচনা করা হবে।


গাড়ি নির্মাতা কোম্পানি


১. টেসলা

গাড়ি নির্মাতা কোম্পানি হিসেবে বর্তমানে সবচেয়ে জনপ্রিয় নাম হলো টেসলা। ২০০৩ সালে কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠিত হয়। কোম্পানিটির প্রধান সদরদপ্তর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের অস্টিনে অবস্থিত। বর্তমানে কোম্পানিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিযুক্ত আছেন ইলন মাস্ক। বর্তমানে ইলন মাস্ক বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি। ২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী শেয়ার মার্কেটে কোম্পানিটির ভ্যালু ৫০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। ২০২৩ সালে টেসলা ১৮ লাখের বেশি গাড়ি বিক্রয় করতে সক্ষম হয়েছে যেটি ২০২২ সালে ছিল ১৩ লাখ অর্থাৎ মাত্র এক বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটি ৩৮% বেশি গাড়ি বিক্রয় করতে সক্ষম হয়েছে। বর্তমানে টেসলার Model Y পৃথিবীর সবচেয়ে বিক্রয়কৃত গাড়ি এবং এটি একটি বিদ্যুৎ চালিত গাড়ি। টেসলার Model Y এর মূল্য ৪৫ হাজার ডলার থেকে শুরু হয়। কোম্পানিটি ২০২৩ সালে ১০ বিলিয়ন ডলারের অধিক মুনাফা অর্জন করেছে। ২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী কোম্পানিটির কর্মচারীর সংখ্যা ১ লাখ ৪০ হাজার। কোম্পানিটির মূল লক্ষ্য হলো বৈদ্যুতিক গাড়ির জগতে বিপ্লব নিয়ে আসা।


২. টয়োটা

গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ প্রতিষ্ঠান হিসেবে টয়োটা পরিচিত। জাপানে ১৯৩৩ সালে টয়োটা কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠিত হয়। টয়োটার প্রধান সদর দপ্তর জাপানের আইচি শহরে অবস্থিত। কোজি সাতো বর্তমানে কোম্পানিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিযুক্ত আছেন। ২০২৪ সালের জুন মাসের তথ্য অনুযায়ী কোম্পানিটির শেয়ার মার্কেট ক্যাপ ২৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী কোম্পানিটি ১ কোটি ১০ লাখের বেশি গাড়ি বিক্রি করেছে যেটি ২০২২ সালের তুলনায় ৭% বেশি। টয়োটার সর্বোচ্চ বিক্রয় হওয়া গাড়ির মডেলটি হল Toyota RAV4 এবং কোম্পানিটি এই মডেলের ১০ লক্ষেরও বেশি গাড়ি বিক্রয় করতে সক্ষম হয়েছে। Toyota RAV4 মডেলটি পৃথিবীর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিক্রয় হাওয়া গাড়ি এবং প্রথম স্থান দখল করে আছে টেসলার Model Y গাড়িটি। টয়োটার একমাত্র বৈদ্যুতিক গাড়ির মডেলটি হচ্ছে Toyota bZ4X । বর্তমানে টয়োটার শুধুমাত্র এই মডেলটি ছাড়া আর কোন বৈদ্যুতিক গাড়ির মডেল নেই সুতরাং বৈদ্যুতিক গাড়ির প্রতিযোগিতায় টয়োটা বহু পিছিয়ে আছে। তবে ভবিষ্যতে বৈদ্যুতিক গাড়ির উৎপাদন বাড়াতে টয়োটা অনেক আগ্রহী এবং তারা বহু পদক্ষেপ‌ও নিয়েছে। ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী কোম্পানিটি ৪৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি মুনাফা অর্জন করেছে। ২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে কোম্পানিটিতে মোট কর্মচারীর সংখ্যা ৩ লাখ ৮০ হাজারের বেশি।


৩. বিওয়াইডি

ইলেকট্রিক গাড়ির জগতে বর্তমানে সবচেয়ে আলোচিত নাম বিওয়াইডি। বর্তমানে সবচেয়ে বেশি বিক্রয় হওয়া বৈদ্যুতিক গাড়ির তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে আছে BYD Song Plus মডেলের গাড়িটি। ১৯৯৫ সালে উন্নত প্রযুক্তি সম্পন্ন গাড়ি তৈরির উদ্দেশ্যে বিওয়াইডিকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। বিওয়াইডির প্রধান সদরদপ্তর চীনের শেনচেন শহরে অবস্থিত। ২০২৪ সালের জুন মাসের তথ্য অনুযায়ী শেয়ারবাজারে কোম্পানিটির মার্কেট ক্যাপ ৯০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। বিওয়াইডি চীনের সর্ববৃহৎ গাড়ি প্রস্তুতকারক কোম্পানি। কোম্পানিটি ২০২৩ সালে ৩০ লাখের অধিক গাড়ি বিক্রয় করতে সক্ষম হয়েছে যেটি ২০২২ সালের তুলনায় ৬৬ শতাংশ বেশি। কোম্পানিটির গাড়ি বিক্রয়ের সবচেয়ে বড় মার্কেট হল চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে বিওয়াইডির গাড়ির চাহিদা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিওয়াইডির গাড়ির দাম তুলনামূলক ভাবে কম ও কোয়ালিটি ভালো হওয়ায় উন্নত দেশগুলোর পাশাপাশি উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ও এর চাহিদা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। চীনে একটি গাড়ি তৈরির খরচ পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম এবং চীনের সরকার কোম্পানিটির উন্নয়নের জন্য প্রচুর অর্থ প্রদান করে থাকে যার ফলে ইলেকট্রিক গাড়ির জগতে কোম্পানিটি টেসলার সাথে প্রতিযোগিতা করছে এবং এগিয়েও আছে। ২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী কোম্পানিটিতে মোট কর্মচারীর সংখ্যা ৫ লাখ ৫০ হাজারের অধিক যার ফলে কোম্পানিটি প্রচুর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করছে। ২০২৩ সালে কোম্পানিটির মোট মুনাফা ছিল ৫.৪ বিলিয়ন ডলার।


আরো পড়ুন: বিশ্বের প্রভাবশালী ব্যাংকগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে নিচের পোস্টটি পড়ুন।



৪. ফেরারী

ফেরারী বিশ্বের অন্যতম একটি স্বনামধন্য কোম্পানি। ইতালির এই স্বনামধন্য কোম্পানিটি প্রাইভেট গাড়ি থেকে শুরু করে অতি বিলাসবহুল স্পোর্টস গাড়িও বানিয়ে থাকে। এনজো ফেরারি ১৯২৯ সালে কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪৮ সালে ফেরারীর তৈরি কোন স্পোর্টস গাড়ি প্রথমবারের মতো রেসিং চ্যাম্পিয়ন হয় এবং এরপর থেকে কোম্পানিটির জনপ্রিয়তা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেতে থাকে। কোম্পানিটির আজ পর্যন্ত রিলিজ হওয়া সেরা পাঁচটি গাড়ির মডেলের মধ্যে আছে Ferrari Enzo, Ferrari SF90 Stradale, Ferrari 812 Superfast, Ferrari F50, Ferrari Dino 246 GT এবং এছাড়াও আরো বহু জনপ্রিয় মডেল রয়েছে। ২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী কোম্পানিটির শেয়ার মার্কেট ভ্যালু ৭০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। ২০১৬ সালে কোম্পানিটির শেয়ার মার্কেট ভ্যালু ছিল মাত্র ৯ বিলিয়ন ডলার যেটি আজ ২০২৪ সালে ৭০ বিলিয়ন ডলারে এসে দাঁড়িয়েছে অর্থাৎ কোম্পানিটি মাত্র ৮ বছরে নিজের মার্কেট সাইজকে ৮ গুণের অধিক বড় করেছে। বর্তমানে কোম্পানিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিযুক্ত আছেন বেনেদেত্তো ভিগনা। ফেরারীর প্রধান সদর দপ্তর ইতালির মারানেলো শহরে অবস্থিত। ফেরারীর সবচেয়ে বেশি বিক্রয় হওয়া গাড়িটির মডেল হল Ferrari F40 । বর্তমানে কোম্পানিটিতে মাত্র ৪ হাজার ৯০০ জন কর্মচারী নিযুক্ত আছেন। ২০২৩ সালে কোম্পানিটির মুনাফা ছিল ১.৭ বিলিয়ন ডলার। ফেরারী বর্তমানে বৈদ্যুতিক গাড়ি তৈরির প্রতিযোগিতায় বহু পিছিয়ে আছে তবে ভবিষ্যতে তারা একটি বৈদ্যুতিক গাড়ি মার্কেটে রিলিজ করতে চায় যার বাজার মূল্য ৫ লক্ষ ডলারের অধিক হতে পারে।


৫. মার্সিডিজ বেঞ্জ

মার্সিডিজ বেঞ্জ অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি জার্মান গাড়ি নির্মাতা কোম্পানি। কোম্পানিটি মোটরগাড়ি, বাস, ট্রাক সহ বিভিন্ন ধরনের যানবাহন তৈরি করে থাকে। কার্ল বেঞ্জ ১৯২৬ সালে কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠা করেন। মার্সিডিজ বেঞ্জ একটি জার্মান ভিত্তিক কোম্পানি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির অর্থনীতির বেহাল দশা হওয়া সত্ত্বেও ১৯২৬ সালে কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠিত হলে ধীরে ধীরে এটি মানুষের নজর কাড়তে সক্ষম হয়। কোম্পানিটির প্রধান সদর দপ্তর জার্মানির স্টুটগার্ট শহরে অবস্থিত। ২০২৩ সালে কোম্পানিটি ২০ লাখের অধিক যানবাহন বিক্রয় করতে সক্ষম হয়েছে এবং কোম্পানিটির সবচেয়ে বড় মার্কেট হলো চীন, জার্মানি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্সিডিজ বেঞ্জের C-Class মডেলের গাড়িগুলো পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি বিক্রয় হয়েছে। ২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী মার্সিডিজ বেঞ্জ এর শেয়ার মার্কেট ভ্যালু ৭০ বিলিয়ন ডলারের অধিক। ২০২৩ সালে কোম্পানিটির মুনাফা ছিল ২২ বিলিয়ন ডলার। ২০২৪ সালের জুন মাসের তথ্য অনুযায়ী কোম্পানিটিতে ১ লাখ ৬০ হাজারের অধিক কর্মচারী কাজ করে।


বিশ্বের সেরা পাঁচটি গাড়ি নির্মাতা কোম্পানির এই রিপোর্টটি মূলত শেয়ার মার্কেটে গাড়ি নির্মাতা কোম্পানিগুলোর সবচেয়ে বেশি মার্কেট ক্যাপ যাদের আছে তাদের প্রথম পাঁচটি কোম্পানিকে নেওয়া হয়েছে। বিশ্বে আরো বহু গাড়ি নির্মাতা কোম্পানি রয়েছে যারা উচ্চ প্রযুক্তি সম্পন্ন এবং কোয়ালিটি সম্পন্ন গাড়ি বানিয়ে চলেছে। উপরে উল্লেখিত এই পাঁচটি কোম্পানির শেয়ার মার্কেটে গড় মার্কেট ভ্যালু এক ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি। সুতরাং বলা যায় যে, গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে মাত্র এই পাঁচটি কোম্পানি পুরো পৃথিবীর মার্কেটকে নিয়ন্ত্রণ করছে। জলবায়ু পরিবর্তন সহ বিভিন্ন সমস্যার কারণে বৈদ্যুতিক গাড়ির চাহিদা প্রতিনিয়ত ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এই বৈদ্যুতিক গাড়ির মার্কেট ধরতে কোম্পানিগুলো ব্যাপক প্রতিযোগিতায় নেমেছে। এই প্রতিযোগিতায় সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আছে চীনভিত্তিক কোম্পানি বিওয়াইডি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানি টেসলা। বৈদ্যুতিক গাড়ির ক্ষেত্রে এই দুইটি কোম্পানির তুলনায় বাকি কোম্পানিগুলো বহু পিছিয়ে আছে। আশা করি আপনি আমাদের এই রিপোর্টটি উপভোগ করেছেন এবং এই ধরনের আরো রিপোর্ট পেতে আমাদের ব্লগের অন্য পোস্টগুলো পড়তে পারেন ধন্যবাদ।

Post a Comment

0 Comments