পৃথিবীর সবচেয়ে অত্যাধুনিক স্পাইওয়্যার Pegasus সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন

Pegasus বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে অত্যাধুনিক একটি স্পাইওয়্যার। এই অত্যাধুনিক স্পাইওয়্যারটি NSO Group তৈরি করেছে। স্পাইওয়্যারটি তৈরির প্রধান উদ্দেশ্য হলো সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলা, জাতীয় নিরাপত্তা, অপরাধ দমন এবং গোপন নজরদারি। ২০১১ সালে স্পাইওয়্যারটি তৈরি করা হয় এবং পরবর্তীতে এটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। আজকের এই পোস্টে স্পাইওয়্যারটি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।



Pegasus




স্পাইওয়্যার কাকে বলে?

স্পাইওয়্যার একধরনের গোপন নজরদারি সফটওয়্যার। এটি কোন ডিভাইসে ইন্সটল করলে সেই ডিভাইস থেকে বিভিন্ন রকম তথ্য নেওয়া যায় এমনকি সেই ডিভাইসটি স্পাইওয়্যার দ্বারা নিয়ন্ত্রণ ও করা যায়। স্পাইওয়্যার কোনো ডিভাইসে ইন্সটল করার বিভিন্ন পদ্ধতি আছে এটি নির্ভর করে স্পাইওয়্যারটি কতটা শক্তিশালী তার উপর যেমন:

  কম শক্তিশালী স্পাইওয়্যার গুলো যে ডিভাইসে ইন্সটল করতে চান সেই ডিভাইসে সাধারণ সফটওয়্যারের মতো‌ই ইন্সটল করতে হয়।

  মাঝারি শক্তিশালী স্পাইওয়্যার গুলো কোনো ফাইল ডাউনলোডের মাধ্যমে একটি ডিভাইসে ইন্সটল করে দেওয়া সম্ভব।

  Pegasus এর মতো অত্যাধুনিক অতি শক্তিশালী স্পাইওয়্যার গুলো সাধারণ একটি ফোন কল অথবা মেসেজের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট ডিভাইসে ইন্সটল করা সম্ভব।


একটি ডিভাইসে স্পাইওয়্যার ইন্সটল করলে সেই ডিভাইস থেকে সকল তথ্য আপনি সংগ্রহ করতে পারবেন এবং সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন যেমন ডিভাইসটির সকল ফাইল আপনি ডাউনলোড করতে পারবেন বা ইচ্ছা মতো ডিলিট করতে পারবেন, সিম কার্ড, ক্যামেরা, মাইক্রোফোন ইত্যাদি সকল কিছু আপনি দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। সহজ ভাষায় বলতে গেলে একটি ডিভাইসে স্পাইওয়্যার ইন্সটল করে সেই ডিভাইসটি সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণে নেওয়া সম্ভব তবে স্পাইওয়্যারটি অবশ্যই শক্তিশালী হতে হবে।


NSO Group Technologies

Pegasus স্পাইওয়্যারটি মূলত NSO Group তৈরি করেছে। NSO Group ইসরাইলের একটি সাইবার নিরাপত্তাকারী কোম্পানি এটির প্রধান সদর দপ্তর ইসরাইলের Herzliya শহরে অবস্থিত। কোম্পানিটি ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এটির মূল লক্ষ্য হলো নিরাপত্তা হুমকি মোকাবেলা, সন্ত্রাসবাদ দমন, সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়িত এমন মানুষের উপর নজরদারি বাড়ানো ইত্যাদি। কোম্পানিটি সাইবার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রজেক্টে কাজ করলেও কোম্পানিটির সবচেয়ে জনপ্রিয় স্পাইওয়্যারটি হলো Pegasus । NSO Group মূলত সরকারি সংস্থাগুলোর সাথে ব্যবসা করে তারা কোনো ব্যক্তিগত সংস্থা অথবা ব্যক্তির কাছে তাদের পণ্য বিক্রয় করে না। কোম্পানিটি ইসরাইলের মিত্র দেশগুলোকে এই অত্যাধুনিক স্পাইওয়্যারটির সেবা প্রদান করে থাকে। কোম্পানিটি স্পাইওয়্যারটিকে জঙ্গিবাদ এবং বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড রুখে দেওয়ার জন্য ব্যবহারের অনুমতি দিলেও অতীতে দেখা গিয়েছে স্পাইওয়্যারটি বিভিন্ন সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের ওপর নজরদারির জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়াও কোম্পানিটির উপর আরো বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ রয়েছে।


Pegasus স্পাইওয়্যারটি কতটা শক্তিশালী?

Pegasus অত্যন্ত শক্তিশালী একটি স্পাইওয়্যার। স্পাইওয়্যারটি জিরো ক্লিক ইনফেকশনের ক্ষমতা রাখে অর্থাৎ ইউজারের কোনো ইন্টারঅ্যাকশন ছাড়া সাধারণ একটি ম্যাসেজ অথবা ফোন কলের মাধ্যমে স্পাইওয়্যারটি একটি ডিভাইসে ইন্সটল হতে সক্ষম। এটি কোন ডিভাইসে ইন্সটল হলে ইউজারের পক্ষে সেটি বুঝতে পারা খুবই কঠিন। এর অন্যতম কারণ এটি ডিভাইসের পারফরম্যান্স ও ব্যাটারির উপর বেশি প্রভাব পড়তে দেয় না। স্পাইওয়্যারটি আক্রান্ত ডিভাইসের ডাটাগুলো এনক্রিপটেড করে তারপর একটি নিরাপদ সার্ভারে পাঠায় এর ফলে তৃতীয় কোন ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ ডাটা গুলো সংগ্রহ করতে পারেনা। স্পাইওয়্যারটি ডিভাইসের এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপ্টেড অ্যাপগুলোর সুরক্ষা বাইপাস করে তার ডাটাগুলো সংগ্রহ করতে পারে। NSO Group নিয়মিত ভাবে Pegasus কে আপডেট করে এর ফলে আক্রান্ত ডিভাইসের অপারেটিং সিস্টেমে সিকিউরিটি সম্পর্কিত কোনো আপডেট এলে স্পাইওয়্যারটি সেই সিকিউরিটি আপডেটকে বাইপাস করতে সক্ষম হয়।


Pegasus স্পাইওয়্যারটি একটি ডিভাইসের কি কি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে?

Pegasus স্পাইওয়্যারটি একটি ডিভাইসের সকল গুরুত্বপূর্ণ ফিচার ও ফাংশান নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। স্পাইওয়্যারটি কি কি নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম এগুলো নিয়ে নিচে আলোচনা করা হলো।


  স্পাইওয়্যারটির আক্রান্ত ডিভাইস থেকে ডাটা সংগ্রহের পাশাপাশি সেই ডিভাইসে বিভিন্ন ডাটা আপলোড, ডিলিট এবং এডিট করতে সক্ষম।

  স্পাইওয়্যারটি ডিভাইসের সকল কল রেকর্ড করতে সক্ষম এবং কল সম্পর্কে বিভিন্ন লগ সংগ্রহ করতে সক্ষম।

  স্পাইওয়্যারটি ডিভাইসের সকল মেসেজিং অ্যাপগুলোর মেসেজ পড়তে এবং সেগুলো সংগ্রহ করতে সক্ষম। এমনকি এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপ্টেড মেসেজিং অ্যাপগুলোর মেসেজও পড়তে সক্ষম যেমন WhatsApp, Signal, Messenger ইত্যাদি।

  স্পাইওয়্যারটি ডিভাইসের মাইক্রোফোন এবং ক্যামেরা গোপনে চালু করতে সক্ষম এবং এগুলোর মাধ্যমে অডিও ও ভিডিও রেকর্ডিং করতে সক্ষম।

  স্পাইওয়্যারটি সিম কার্ডের সকল তথ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম এবং ইচ্ছা অনুযায়ী কোনো ব্যক্তিকে কল অথবা মেসেজ করতে সক্ষম।

  স্পাইওয়্যারটি ডিভাইসের লোকেশন ট্র্যাক করতে সক্ষম।

  স্পাইওয়্যারটি আক্রান্ত ডিভাইসের সকল ফাইল এবং ডকুমেন্ট কপি, ডিলিট ও এডিট করতে সক্ষম।

  স্পাইওয়্যারটি ডিভাইসের সকল ব্রাউজারের হিস্ট্রি এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম।

  স্পাইওয়্যারটি ডিভাইসে বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশন ইনস্টল এবং রিমুভ করতে পারে এছাড়াও ডিভাইসের বিভিন্ন সেটিং পরিবর্তন করতে পারে।

  স্পাইওয়্যারটির মাধ্যমে ডিভাইসের স্ক্রিন রেকর্ড করা যায় এবং স্ক্রিন রেকর্ডারের মাধ্যমে লাইভ ডিভাইসটির কার্যক্রম মনিটর করা যায়।


এছাড়াও আরো বিভিন্ন কার্যক্রম Pegasus এর মাধ্যমে করা যায়। সুতরাং আপনি বুঝতেই পারছেন এটি কতটা শক্তিশালী স্পাইওয়্যার।



Pegasus স্পাইওয়্যারটি কীভাবে ক্রয় করবেন?

NSO Group এর নীতিমালা অনুযায়ী Pegasus স্পাইওয়্যারটি কোন ব্যক্তি অথবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রয় করা হয় না। শুধুমাত্র কোন দেশের সরকার এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সাথে কোম্পানিটি ব্যবসা করে থাকে।
সাধারণ ব্যক্তি ও বেসরকারি সংস্থার কাছে স্পাইওয়্যারটি বিক্রয় না করার মূল কারণ হলো নিরাপত্তা। Pegasus যেহেতু অতি শক্তিশালী একটি স্পাইওয়্যার সেহেতু এটি যেন কোন অসাধু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের হাতে না চলে যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখা NSO Group এর প্রধান একটি দায়িত্ব।

Pegasus স্পাইওয়্যারটির দাম বিভিন্ন বিষয়ের উপর নির্ভর করে। ২০১৬ সালের তথ্য অনুযায়ী ১০ টি আইফোনে Pegasus Setup এর খরচ ছিল ৬ লাখ ৫০ হাজার ডলার এবং প্রতি বছর তাদের সার্ভিস ফি দিতে হতো ৫ লাখ ডলার। এছাড়াও ২৫ টি ফোন নম্বর মনিটর করার জন্য  ৮ মিলিয়ন ডলার দিতে হয় এবং সাথে অনান্য সার্ভিস ফি দিতে হয়। এটি ২০১৬ সালের রিপোর্ট তবে বর্তমানে এই স্পাইওয়্যারটির চাহিদা প্রচুর বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সেই সাথে দাম ও বৃদ্ধি পেয়েছে।
NSO Group যেহেতু ইসরাইলের একটি কোম্পানি সেহেতু কোম্পানিটি এই স্পাইওয়্যার ইসরাইলের বন্ধুসুলভ এবং ইসরায়েলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোকে বিক্রয় করে যেমন সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশর, ভারত, ফ্রান্স, কানাডা ইত্যাদি।
এছাড়াও আরো বহু দেশে এই স্পাইওয়্যারটির ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে।
সুতরাং আপনি বুঝতেই পারছেন Pegasus ক্রয় করা একদমই সহজ ব্যাপার নয় এবং এর মূল্যও অনেক বেশি। স্বল্প কিছু দেশ এবং সংস্থা এই স্পাইওয়্যারটি ব্যবহারের সুযোগ পায়।


NSO Group এবং Pegasus নিয়ে কিছু নেতিবাচক সমালোচনা।

NSO Group এর নীতিমালা অনুযায়ী Pegasus স্পাইওয়্যারটি গণমাধ্যম কর্মী, মানবাধিকার সংস্থা ছাড়াও বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহারের অনুমতি না থাকলেও অতীতে এসব নীতিমালা লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে।
কোম্পানিটির বিরুদ্ধে আনা কিছু গুরুতর অভিযোগ নিয়ে নিচে আলোচনা করা হলো।

  স্পাইওয়্যারটি বিভিন্ন দেশে সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী এবং বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের উপর ব্যবহার করার অভিযোগ উঠেছে।

  স্পাইওয়্যারটি যেহেতু ব্যবহারকারীর অনুমতি ছাড়াই বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করতে পারে সেহেতু কোম্পানিটির বিরুদ্ধে গোপন নজরদারি এবং ইউজারের গোপনীয়তা লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে।

  মেক্সিকো, ভারত, সৌদি আরব সহ বিভিন্ন দেশে স্পাইওয়্যারটি মানবাধিকার কর্মীদের উপর নজরদারির কাজে ব্যবহারের প্রমাণ মিলেছে।

  স্পাইওয়্যারটি বিভিন্ন অগণতান্ত্রিক সরকারকে ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার হয়েছে যার ফলে সেই দেশের মিডিয়া এবং জনগণের উপর নজরদারির মাত্রা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে।

উপরের উল্লেখিত অভিযোগ গুলো ছাড়াও আরো বিভিন্ন অভিযোগ কোম্পানিটির উপর আছে। তবে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ থাকলেও এটি বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরকারকে সাহায্য করেছে যেমন জঙ্গিবাদ দমন, অবৈধ ব্যবসায়ীদের উপর নজরদারি, দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা ইত্যাদি। কিন্তু অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে কোম্পানিটি তাদের নিজস্ব নীতিমালার বিরুদ্ধে গিয়ে কাজ করলে সেটি স্পাইওয়্যার ব্যবহারকারী দেশ এবং দেশের জনগনের জন্য একটি হুমকির বিষয় হয়ে দাঁড়াবে।


উপসংহার

NSO Group Pegasus ছাড়াও আরো বিভিন্ন অত্যাধুনিক টেকনোলজি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে যেমন Circles, Eclipse, Phantom, Fleming ইত্যাদি। তাদের বেশিরভাগ প্রোডাক্ট‌ স্পাইয়িং টুল এবং এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো Pegasus । কোম্পানিটি নজরদারির জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে Pegasus স্পাইওয়্যারটির মাধ্যমে। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। কোম্পানিটির মূল লক্ষ্য নজরদারি টুল গুলোকে আরো উন্নত করা এবং এগুলোকে বিভিন্ন দেশের সরকার অথবা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কাছে বিক্রয় করা যাতে অপরাধী এবং সন্ত্রাসীদের খুঁজে বের করা সহজ হয়। কোম্পানিটি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত নয়। তাদের আয়ের মূল উৎস হলো বিভিন্ন দেশের সরকার অথবা সংস্থার সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে কাজ করা। Pegasus ইউজারের অজান্তেই একটি ডিভাইসে প্রবেশ করতে পারে সুতরাং এটিকে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী স্পাইওয়্যার বলা যায়।

Post a Comment

0 Comments